এই  প্লাবনের দায় কার! আমরাই আমাদের সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়বোই, গড়বো।


অতিবৃষ্টি ও উজান পানির চাপে অসহনীয় অতিবন্যা

মোঃ অহিদুজ্জামান (রুমু) : ২১ আগষ্ট থেকেই  আবহাওয়া বার্তা ছিল, সমগ্র ত্রিপুরা ও এর পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের জেলাগুলোতে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকবে। 

একই দিনে অতিবর্ষনের ভারী  প্রবাহের এই ঘটনায়, বাংলাদেশ থেকে ৮০ কিলোমিটার উজানে ভারতের ত্রিপুরার স্বল্প উচ্চতাবিশিষ্ট (প্রায় ৩০ মিটার) ডম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধটি অতিরিক্ত  পানির চাপে ও বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার আশংখায় খুলে দেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালের পর প্রথমবারের মতো এই প্রকল্পের বাঁধ খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

দ্বিপাক্ষিক প্রটোকলের অংশ হিসাবে ডম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অমরপুর স্টেশন থেকে বাংলাদেশে ২১ আগষ্ট ত্রিপুরার সময় বিকাল ৩ টা পর্যন্ত পানি ধেয়ে আসার বার্তা পাঠায়। না পাঠালেও সমস্যা নাই। কারন ত্রিপুরার ডম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বাংলাদেশ সীমানার দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। বানের পানির এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম, বাংলাদেশে আগাম প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ঠ। এই দিন  সন্ধ্যা ৬ টার পর ত্রিপুরা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। 

বাঁধ খুলে যাওয়ায় স্বস্তিতে নেই ত্রিপুরাও। বাঁধের উজান অংশ সমভূমিতে নদীর পানির ধারনক্ষমতার বাইরে চলে গেলে পূর্নাঙ্গ গেট খুলে দেওয়া হয়। ফলে ত্রিপুরাসহ বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারন করেছে। ত্রিপুরায়, বাঁধের অপর পাশের হাহাকার আরও বেশী।

এদিকে বাংলাদেশ অংশে ত্রিপুরার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হাওড়া নদী  ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, ধলাই নদী মৌলভীবাজারে, মুহুরি নদী ফেনী জেলায় এবং খোয়াই নদী সিলেটে প্রবেশ করেছে। আর মূল গোমতি কুমিল্লাতে প্রবেশ করেছে। সব নদী গুলোই নাব্যতা হ্রাস,  অতিবৃষ্টি ও উজান পানির চাপে এই অসহনীয় অতিবন্যা। 

যে সুফল পাওয়ার আশায় ১৯৭৪ এ এই বাঁধ তৈরি করেছিল ভারত,  আদৌও কি সেই সুফল পেয়েছিল ত্রিপুরা? আসুন জেনে নেই সেই প্রশ্নের উত্তর। সে আরেক করুন ইতিহাস। 

রাইমা উপত্যকার উর্বর জমিতে ১২ হাজার আদিবাসী পরিবার বাস করতো। এখানেই মিলিত হয়েছে রাইমা-সাইমা (সারমা) নদী। আর এই উপত্যকা তৈরি করেছিল গোমতি নদী। এই  গোমতির উৎপত্তিস্থল, ডম্বুর হ্রদ থেকে তিন কিলোমিটার ভাটিতে  ভাটিতে তীর্থমুখে নির্মিত হয়েছিল এই ডম্বুর ড্যাম বা বাঁধ। বাঁধ নির্মানের আগে ত্রিপুরার ঐ তীর্থমুখ এলাকাটি তীর্থস্থান হিসাবে ব্যবহৃত হতো। বাঁধের উজানে  ৪৪টি দ্বীপসহ মনোরম হ্রদটি একসময় ১২ হাজার পরিবার এবং ২৭ হাজার আদিবাসী টিপরাসা কৃষকের উর্বর ধান ক্ষেত ছিল।

১৯৭৪ সালে ভারত সরকার রাইমা উপত্যকার আদিবাসীদের সম্পর্কে বাস্তবতা এবং ফলাফলের কোনো হিসাব না করেই উর্বর জমিতে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন এই  বাঁধের কারণে ২৭ হাজার আদিবাসী টিপরাস তাদের ঘরবাড়ি হারায়। তাদের সব জমিজমা পানির নিচে তলিয়ে যায়।

এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি ১৯৭৬ সালে চালু করা হয়েছিল। এর দুটি ইউনিটের ১০ মেগাওয়াট উৎপাদন করার ক্ষমতা ছিল। ১৯৮৪ সালে স্ট্যান্ডবাই হিসাবে পাঁচ মেগাওয়াটের একটি তৃতীয় ইউনিটও নির্মাণ করা হয়েছিল।

কিন্তু  বাস্তবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি প্রত্যাশিত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়েছে। গত পাঁচ বছরে, প্রকল্পটি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কারণ হ্রদের ভারী পলির কারণে আশেপাশের দুটি পাহাড়ি শ্রেণি থেকে ব্যাপক মাটি ক্ষয়ের কারণে প্রচুর পরিমাণে বন উজাড় হয়েছে। প্রকল্পে ১৫ মেগাওয়াট উৎপাদন করার কথা ছিল। বাস্তবে এটি ২ থেকে ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। প্রতি বছর দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুমে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ হ্রদের পানির স্তর কমে যায় এবং টারবাইনগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত পানি পায় না।

প্রকল্পের অযৌক্তিকতা বিবেচনা করে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে টি পরিত্যাগ করার এবং ডম্বুর হ্রদের ৪৪টি দ্বীপের পাশাপাশি আদিবাসী গ্রামের কাছাকাছি জমিগুলোকে পর্যটন স্পটে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। সুতরাং এই ডম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ ত্রিপুরারও দুঃখ। 

আমাদের ব্যর্থতা হলো আগাম আভাস পেয়েও আমরা আক্রান্ত জনপদকে সতর্ক করতে পারি নাই। এছাড়া অগাস্টের শুরুতেই মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭টি অংশে ভাঙনের দেখা দিলেও সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে পারি নাই। বিভিন্ন স্থানে বাঁধের ভাঙা জায়গা স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। মঙ্গলবার সকালে থেকে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়। একে একে তলিয়ে যেতে থাকে পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার এলাকা। 

এছাড়া সিলেট অঞ্চলের উজানের নদীগুলোর নুড়ি পাথর সংগ্রহে সরকারী বাধা থাকায় সব নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এটাও এই প্লাবন-বন্যার অন্যতম কারন।গভীরতা বাড়াতে  অন্যান্য নদীগুলোতে বৈজ্ঞানিক  নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বালি উত্তোলন বা ড্রেজিং করা সম্ভব হচ্ছে না, একই কারনে। এক্ষেত্রে স্বৈরাচারের দোসর কিছু পরিবেশবাদী এনজিও গুলোর দায়ও কম নয়। এই এনজিও গুলোর এক অংশের প্রতিনিধি  এখন  অর্ন্তবর্তী বিল্পবী সরকারের উপদেষ্টা। নুড়ি পাথর ব্যবসাকে আমদানী নির্ভর করে একটা গোষ্ঠীর স্বার্থে  তারা হাই কোর্টে ঐ  রিট করেন। এ কারনে সিলেট  অঞ্চলে নদীর স্রোতে আসা পাথর সংগ্রহও বন্ধ হয়।ফলশ্রুতিতে  বাংলাদেশের এই অঞ্চলের উজানের নদীর পানি ধারন ক্ষমতা তলানীতে পৌছেছে এবং সহজেই প্লাবন হয়।

আশার কথা, দেশের মানুষ তাদের ফোকাস পয়েন্ট ঠিক করতে শিখে গেছে। দেশের সংকটে সবাই এক হয়ে সেই সংকটের প্রতিকার/প্রতিরোধ করার জন্যই লড়ছে।

আক্রান্ত  কমপক্ষে  দশটি জেলাতে  সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত দুর্গতদের এক কোটি ৮২ লক্ষ টাকার উপরে নগদ সহায়তা দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, প্রশাসন, রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সকল দল ঝাঁপিয়ে পড়েছে। । এমনকি বন্যার্তদের জন্য শিক্ষার্থীদেরও অর্থ সংগ্রহ চলছে। কেউ কারো আশায় বসে নেই। কেউ ভাবছে না তারা হিন্দু না মুসলিম।  এটাই আমাদের সম্প্রীতির বাংলাদেশ। আমাদের বাংলাদেশ আমরাই গড়বোই গড়বো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *