মোঃ অহিদুজ্জামান (রুমু) : শাহজালাল বিমানবন্দরে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কমান্ড সেন্টারটি বিনা নোটিশে দখল করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্সের (এভসেক) বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় এভসেক এর বিরুদ্ধে থানায় সাধারন ডায়েরিও করেছে এপিবিএন। এ ঘটনায় বিমানবন্দরে কর্মরত সরকারি এ দুটি সংস্থা যেন একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। এপিবিএন এর অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরে অফিসটিতে তারা দায়িথ্ব পালন করছিলেন। এখন অফিসটি না থাকায় দায়িত্ব পালন করতে অসুবিধা হচ্ছে।
এঘটনায় শাহজালালে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।
গত মঙ্গলবার বিমানবন্দর আর্মড পুলিশে কর্মরত সহকারী পুলিশ সুপার জাকির হোসেনের করা সাধারন ডায়েরিতে বলা হয়েছে, ‘সকাল সোয়া ১০টার দিকে এভসেকে কর্মরত স্কোয়াড্রন লিডার তাসফিক তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে জানান, অ্যাপ্রোন এরিয়ার ৩৩ নম্বর গেটে আপনাদের (এপিবিএন) অফিস থেকে মালামাল সরিয়ে ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেটে রাখা হয়েছে। আপনাদের পুলিশ পাঠিয়ে এগুলো নিয়ে যান।
পরে তিনি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পূর্বে না জানিয়ে কেন মালামালগুলো সরিয়ে অন্যত্র রাখলো— এমন প্রশ্নে এভসেকের ডেপুটি ডিরেক্টর অপারেশন সাইফুর রহমান জানান, বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম ও এভসেকের ডিরেক্টর উইং কমান্ডার জাহাঙ্গীরের নির্দেশে এগুলো সরানো হয়েছে।’
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, পরে তথ্য নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ওই অফিসের প্রবেশমুখে বাম পাশে দেয়ালে লেখা এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ, এয়ার সাইড কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল লেখা সাইনেবার্ডটি ভঙ্গুর অবস্থায় অফিসের ভেতরে রাখা হয়েছে। অফিসের ভেতরে থাকা সরকারি কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস, ২০১০ সাল থেকে রক্ষিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথিপত্র নির্দিষ্ট স্থানে পাওয়া যায়নি।
অফিসের সিসি ক্যামেরাটি সাদা কাগজে মোড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায়। অফিসের সামনের এপিবিএনের লোগো সম্বলিত স্টিকার উৎপাটন করে বিএফ টাস্কফোর্স লেখা, একই সঙ্গে বিমানবাহিনী ও সিভিল এভিয়েশনের লোগো বসানো রয়েছে। সিসি ক্যামেরাটি ভারী কাগজে মোড়ানোর কারণে কী কী মালামাল ও গুরুত্বপূর্ণ কী কী নথি সরানো হয়েছে তা সিসি ক্যামেরা বিশ্লেষণে পরিপূর্ণভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।’
এরইমধ্যে অ্যাপ্রন এলাকায় (অ্যাপ্রোন এলাকা হলো যেখানে বিমান পার্ক করা, লোড-আনলোড করা, রিফুয়েল করা বা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়) থাকা এপিবিএনের কমান্ড সেন্টারটি দখলে নিয়ে সেটিকে নিজেদের অফিস বানিয়ে ফেলেছে এভসেক। অভিযোগ উঠেছে, এভসেকের বাধায় ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারছে না এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। শাহজালাল থেকে এপিবিএন সদস্যদের সরিয়ে দিতে এমনটা করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সরকারি দুই সংস্থার এমন মুখোমুখি অবস্থান বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য শঙ্কা হয়ে দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিকভাবেও শাহজালাল বিমানবন্দরের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এভসেকে যে জনবল রয়েছে তা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের বাইরে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বিমান বাহিনী থেকে ৫০০ এর বেশি জনবল নিয়োগ দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ১৬০ জন, বাংলাদেশ পুলিশের ৭৯ জন শাহজালালে কর্মরত আছেন। এছাড়া চলতি বছরের গত ৩ অক্টোবর আবারও ৩২৮ জনসহ আরও প্রায় ১ হাজার জনের নিয়োগের অনুমোদন চাওয়া হয়। যেহেতু এপিবিএন শাহজালালে দায়িত্বরত রয়েছে— সেখানে তাদের বাদ দিয়ে আলাদাভাবে কেন জনবল নিয়োগের আবেদন করলো বেবিচক, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
আর সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১০ সালের ১ জুন বিমাবন্দরে নিরাপত্তার কাজ শুরু করে আর্মড পুলিশ। নিরাপত্তার পাশাপাশি চোরাচালান রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এপিবিএন।
এভিয়েশন বিশ্লেষক ড. কুদারাত-ই খুদা বলেন, দুটি সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাড়তি অন্য কোনও সংস্থা থেকে নিরাপত্তার জন্য লোক আনার প্রয়োজন নেই।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থান কারও কাম্য নয়। বিশেষ করে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো একে-অপরের সঙ্গে সহমর্মিতা নিয়ে কাজ করবে, এটাই কাম্য।
তিনি বলেন, বিমানবন্দরে নিরাপত্তার বিষয়টি একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে থাকা উচিত। পৃথিবীর সব দেশেই এটি রয়েছে। অথচ আমাদের এই বিমানবন্দরে প্রায় ২৫/৩০টি সংস্থা নিজ নিজ এখতিয়ারে কাজ করে। এদের প্রত্যেকের পৃথক কমান্ড। এ কারণে মাঝে মাঝেই সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা যতদিন পর্যন্ত একটি সেন্ট্রাল কমান্ডের আওতায় না আসবে, ততদিন এ অবস্থা চলতে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, ‘এ রকম মুখোমুখি অবস্থানে না থেকে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলে নিরাপত্তা আরও সুসংহত থাকবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিরাপত্তা ইস্যু আরও প্রশংসিত হবে।
এপিবিএনের অধিনায়ক শিহাব কায়সার খান বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতা অগে যেমন ছিল এখনও রয়েছে। আমরা দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমাদের সেটি করতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি পরিপত্র, আইকাও (আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা)-এর নিয়মাবলি যেভাবে রয়েছে, আমরা সেভাবেই দায়িত্ব পালন করে আসছি। এখন কী কারণে এপিবিএনকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে সেটি বোধগম্য নয়। অ্যাপ্রন এরিয়ায় আমাদের যে অফিসটি ছিল, আমাদের না জানিয়ে সেটি তারা নিয়ে গেছে।’
এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া বলেন, ‘আমাদের কোথাও কোনও সমস্যা নেই। এপিবিএন ও এভসেক নিজেদের মতো করে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কারও মধ্যে কোনও সমস্যা নেই।’ সূত্র : এভিয়েশন নিউজ